আজ আমরা কথা বলবো জনপ্রিয় বাউল শিল্পী শ্রী কার্তিক দাস বাউলের কথা। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি বাউল গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে তার গুরুদেব শ্রী দেব দাস বাউল এর সঙ্গে তিনি ১৯৮৫ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে ইন্দো-আমেরিকান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বাউল গান দর্শকের সামনে পরিবেশন করেন।
এরপর ২০০০ সালে বঙ্গ সম্মেলনে তার গুরুদেবের সঙ্গে তিনি আমেরিকার ‘আটলান্টিক সিটি’তে বাউল গান গেয়ে দর্শকদের মন জয় করে নেন
২০০১ এ দালাইলামার আমন্ত্রণে তিনি এবং তাঁর গুরু সমেত মোট চারজন জাপানের হিরোশিমায় গিয়ে বাউল গান গেয়েছিলেন। সেখানকার দর্শকদের বিপুল ভালোবাসা পান তারা।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন মুম্বাই, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর চেন্নাই সহ সমগ্র জায়গায় তিনি পারফর্ম করেন। এই বাউল গানের সূত্র ধরেই তিনি দীর্ঘদিন চেন্নাইতে ছিলেন। জনপ্রিয় সুরকার এ আর রহমানের স্টুডিওতে আমির খানের ছবি ‘মঙ্গল পাণ্ডে দ্য রাইজিং’ এ তিনি কৈলাশ খের এবং সুখবিন্দর সিংয়ের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন। বিশিষ্ট পরিচালক মীরা নায়ারের ‘দ্য নেমসেক টু’ ছবিতেও তিনি গান গেয়েছিলেন। বাংলাদেশের তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’ ছবিতেও তিনি গান গেয়েছিলেন।
কার্তিক দাস বাউল এর একটি ব্যান্ড রয়েছে সেই ব্যান্ডের নাম ‘দ্য বোলপুর ব্রুজ’। এই ব্যান্ডের দুজন গিটারিস্ট রঞ্জন দাস এবং অ্যারেল ডরনার, ড্রামে রয়েছেন হিমাদ্রি শেখর, কিবোর্ডে রয়েছেন অরিন্দম। তিনি নিজে এই ব্যান্ডের একমাত্র ভোকালিস্ট।
তিনি জানান ‘দ্য বোলপুর ব্লুজ’ এর বেশ কিছু গান ইউটিউবে ছাড়বেন।
ব্যান্ড প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন যদি এখনকার ছেলেমেয়েরা আমাদের বাউল গান ব্যান্ড পারফর্ম করতে পারে তাহলে আমরা কেন বাউল গান নিয়ে ব্যান্ডে পারফর্ম করতে পারবোনা।

কলকাতার প্রথম বাউল বাংলা ব্যান্ড ‘অভিলাষা’র সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। শ্রী তনময় বোসের সঙ্গেও তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন মুম্বাই দিল্লি কলকাতা এবং লন্ডনে।
লন্ডনের টেকটার গ্লোব থিয়েটার এ তিনি তন্ময় বোস, অনুষ্কা শঙ্করের সঙ্গে একই মঞ্চে পারফর্ম করেছেন।
বাউল গান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন আমরা মূলত মহাজন’ গান গাই। মহাজন’ অর্থাৎ পদকর্তা, যিনি পদ অর্থাৎ কবিতা লেখেন তাদেরকে মহাজন’ বলা হয়। তিনি দুদ্দুশা, পাঞ্জুশা, লালন ফকির, ভবা পাগলা, শরৎ গোসাই, নীলকন্ঠ মহারাজ প্রমুখের বাউল গান গান গেয়ে থাকেন।
তিনি আরো বলেন বর্তমানে বাউল গান শোনান লোক খুবই কম বয়স্ক বাউল শিল্পীরা সবসময় মহাজন পদ গাইবে কিন্তু এখন যে ধরনের বাউল গান হচ্ছে সে ধরনের গান বেশিদিন টিকবে না। কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন “বাউল গান শিখতে হলে প্রকৃত বাউল শিল্পীর কাছে যেতে হবে, তাদের কাছে শিখতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে। জিন্স প্যান্ট পড়ে আর গাড়ি চড়ে বাউল গান গাওয়া যায় না। বাউল শিল্পীরা কখনোই এ ধরনের জীবন যাপন করে না তারা সব সময় গুরু নির্দেশ মত কাজ করে এবং নির্দেশ মত জীবন যাপন করে। এ ধরনের পোশাক-আশাক পরে থাকলে বাউল সমাজের প্রতি সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে এবং তাদের কাছে বাউল সম্প্রদায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে ঠুনকো হয়ে আসবে”।
তিনি বলেন “বর্তমানে মুষ্টিমেয় বাউল শিল্পী রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নক্ষত্র দাস বাউল, কানাই দাস এবং দেবদাস বাউল। এই বাউল শিল্পীদের সঠিক গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তাদের সেভাবে কোন আর্থিক সাহায্য করা হয় না। বহু গুণী বাউল শিল্পী অর্থাভাবে মারা গেছেন”।
তিনি বলেন “বিভিন্ন উৎসব কমিটি, আয়োজক কমিটি আমাদের বেশি পারিশ্রমিক দিতে চায়না তাদের কষ্ট হয়। অন্যদিকে মুম্বাই থেকে শিল্পীদের লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে আনতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। চিরকালই বাউল সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়ে এসেছিল এবং বর্তমানেও হচ্ছে।
তিনি ‘বিগ বস বাংলা’তেও গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অনেক অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করেন। তিনি বলেন “একটা মানুষের জীবন কত কষ্টের হয়, বাইরের সমস্ত সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি ঘরের মধ্যে বন্দি। নিজেকে ভালোভাবে যাচাই করা যায় সেখানে থাকার মধ্যে দিয়ে”।
তিনি বলেন শুধু বাঙালীদের নয়, অবাঙালিদেরকেও বাউল গান, তাদের বাউল গানের সংস্কৃতি সম্পর্কে বোঝানোটা জরুরি।
অনলাইন পারফর্ম করার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন” গতবছর ‘নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি সোসাইটি’ জন্য জুন মাসে আমরা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠান করেছিলাম। এরপর দুর্গাপূজার সময় স্টুডিও ভাড়া করে সেখানে সেট আপ বানিয়ে দিল্লির একটি পুজোর জন্য আমরা পারফর্ম করেছিলাম ভার্চুয়ালি। এছাড়াও কালিপুজোর সময় দেও দুটি ভার্চুয়ালি বাউল অনুষ্ঠান আমরা করেছিলাম।
বর্তমানে অতিমারির সময় এখন যেহেতু বাইরে শ্যে করা সম্ভব নয় তাই অপেক্ষা করছেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার। ভার্চুয়ালি ও বর্তমানে খুব একটা শ্যো এর ডাক আসছে না।