‘মেথর’ কথাটা শুনলে আপনাদের কি মনে হয়? সত্যি কথাটা বলবেন কিন্তু। জানি আপনাদের চোখ মুখের এক্সপ্রেশন কি হচ্ছে। এইটাই হচ্ছে সমস্যা। আমাদের চিন্তাভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি সঠিকভাবে এখনো পরিণত হয়নি যার ফলে সমাজের বহু নিচ তলার মানুষদের প্রতিনিয়ত অবহেলিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে হয়।
মনে পড়ে ছোট বেলায় আমরা পড়তাম ‘মেথর’ সমাজকর্মী। সমাজকর্মীদের কাজকে আমাদের সম্মান এবং শ্রদ্ধা করা উচিত। একজন চিকিৎসক, সেবিকা, পুলিশ কর্মচারী মতই মেথরও একজন সমাজকর্মী। বুকে হাত রেখে বলুন তো আমরা সত্যিই কি তাদের সমাজের অঙ্গ মনে করি? সত্যিই কি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি? তাদের ঘৃণা এবং বিদ্বেষের চোখে দেখি এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে। আমরা পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও একেবারে প্রত্যন্ত ছোটবেলায় পড়া একটি সহজ পাঠ, নীতিগত শিক্ষার পাঠ অবলীলাক্রমে ভুলে গেছি, যার প্রকারান্তর ঘটেছে আমাদের ব্যবহার এবং আমাদের চরিত্রায়নে।

সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমাজের এই নিচের তলার মানুষগুলিকে সব ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যর মতো গুরুত্বপূর্ণ জরুরী পরিসেবার ক্ষেত্রে তাদের সব সময় অবহেলা করা হয়। অথচ অত্যন্ত ছোটবেলা থেকেই আমরা এর বিপরীত শিক্ষা পেয়েছি। কি লাভ বলুনতো এই ধরনের পুঁথিগত শিক্ষা পেয়ে, যেখানে আমাদের শিক্ষা আমাদেরকে সামাজিক নিচ মানসিকতা সম্পন্ন করে তোলে। তাদেরকে আমরা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেইনা। তাদের এই কর্মকাণ্ড ছাড়া আমাদের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট,এমনকি সামাজিক পরিবেশ একেবারে জঞ্জালময়, অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠবে। তারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের উপকার করে থাকে। তার বদলে আমরা কি করি? ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তাদেরকে ছোট করা, তাদেরকে ঘৃণা করা।

আমরা কি পারিনা তাদের যোগ্য সম্মান ঢুকে তাদের ফিরিয়ে দিতে? হাসিমুখে তাদের সাথে একটু কথা বলতে? আর পাঁচটা মানুষের সাথে আমরা যেরকম ব্যবহার করি তাদের সাথে ঠিক একই রকম ব্যবহার করতে? আমরা সবই পারি কিন্তু আমরা করবো না, আমরা সবই জানি কিন্তু আমরা মানবো না। ওইযে শুরুতেই পড়লাম সঠিক শিক্ষার মূল্যায়ন আমরা এখনো পর্যন্ত করে উঠতে পারিনি। পুঁথিগত শিক্ষার কথা বলছি না একবারও, সামাজিক শিক্ষার কথা বলছি যে শিক্ষা আমাদের একে অন্যকে সম্মান করা, একে অন্যকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা করা শেখায় সেই শিক্ষার কথা বলছি।
পরিচালক মাবরুর রশিদ বান্নাহ ঈদের সময় ঠিক এই বিষয়ের ওপর একটি নাটক নির্মাণ করেছেন যার নাম ‘সুইপার ম্যান’।
এই নাটকটিতে অভিনয় করেছেন মুশফিক. আর. ফারহান, পারসা ইভানা, ফজলুর রহমান বাবু, আরিয়া অরিত্রা, জয়নাল জ্যাক, রাশেদ এমরান প্রমূখ।

এই নাটকটিতে একজন ‘মেথরের’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মুশফিক.আর.ফারহান। রেডিও জকি হিসেবে তার উত্থান হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে তার অভিনয় দর্শকদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছে। এই নাটকটিতে তাঁর অভিনয় সত্যিই দেখার মতো। এই নাটকটিতে তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের এখনো পর্যন্ত সবথেকে সেরা অভিনয় করেছেন। তিনি যে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেন, যে ধরনের চিত্রনাট্য নির্বাচিত করেন তা সত্যিই গতানুগতিকতার চেয়ে একটু ভিন্ন ধর্মী হয়। এই নাটকটি জুড়ে প্রতিটি সুক্ষ সুক্ষ মুহূর্ত তিনি যেভাবে অভিনয় দক্ষতার মধ্যে দিয়ে জুড়েছেন এক কথায় অসাধারণ। তিনি এই নাটকটির মধ্যে দিয়ে যে অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন তাতে এইটুকু আশ্বস্ত হলাম যে বাংলাদেশের তথা সারা বিশ্বব্যাপী বাঙালি আগামী প্রজন্ম নাটকের প্রতি আরো বেশি উৎসাহী হবে। এই নাটকটি আপনারা যদি দেখেন তাঁর অভিনয় দেখে আপনারা সমাজের সেই সমস্ত নিচু তলার মানুষ যারা প্রকৃত অর্থে একজন চিকিৎসকের সমতুল্য মর্যাদাসম্পন্ন তাদের কিভাবে পর্যুদস্ত হতে হয় সেই বেদনা, সেই কষ্ট আপনি অনুভব করতে পারবেন। এই চরিত্রটি তিনি ছাড়া আর কারও পক্ষে এত নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না। আশা রাখছি তিনি ভবিষ্যতেও এই ধরনের অভিনয় করে আমাদের আরো মুগ্ধ করবেন।

পারসা ইভানা এখানে মুশফিক. আর.ফারহানের স্ত্রীর চরিত্রে খুবই সুন্দর অভিনয় করেছেন। নাটকটিতে তাঁর সরলতা, তাঁর চোখের চাউনি, তার এক্সপ্রেশন একেবারে নিখুঁত ছিল। ইদানিং নাটকে খুব কম দেখা গেলেও, তিনি যে যে চরিত্রে অভিনয় করেন তাঁর প্রত্যেকটি দর্শকদের মনে আলাদা ছাপ রেখে যায়। তিনি মুশফিক. আর. ফারহানের সঙ্গে দক্ষতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খুব সুন্দর ভাবে অভিনয় করেছেন।
পরিচালক মাবরুর রশিদ বান্নাহ’কথা আর আলাদা করে কি বলবো। তাঁর প্রত্যেকটি চিত্রনাট্য, গল্প নির্বাচন একদিকে যেমন সামাজিকভাবে আমাদের সচেতনতামূলক বার্তা প্রদান করে অন্যদিকে আমাদের সুক্ষ সুক্ষ আবেগ খুব দক্ষতার সঙ্গে তিনি আমাদের সকলের সামনে উপস্থাপিত করেন। তাঁর প্রত্যেকটি নাটকে তিনি আমাদেরকে হাসতে, কাঁদতে, ভালবাসতে, আমাদের নতুন করে কিছু ভাবতে শেখান। আমাদের ছোট ছোট ভালোলাগা, আবেগগুলিকে খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেন।
এইটুকু বলতে পারি এবছর ঈদে যে সমস্ত নাটকগুলি নির্মিত হয়েছে তার সেরা পাঁচটি নাটকের মধ্যে ‘সুইপার ম্যান’ নাটকটি অবশ্যই জায়গা করে নেবে।

এই নাটকটি প্রযোজনা করেছেন খোরশিদ আলম।
এই নাটকটির এডিট এবং কালারের দায়িত্ব সামলেছেন শামিম রহমান।
‘সুইপার ম্যান’ নাটকটি আপনারা অবশ্যই একবার দেখুন। এটি আমাদের কাছে একটি সামাজিক আয়না। বাড়ির আয়নায় তো প্রত্যেকদিন মুখটা দেখি, এবার চলুন না একটু সামাজিক আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখি। হতাশ হবেন না এটুকু বলতে পারি, বাকিটা সুপারম্যান নাটকটি দেখলেই বুঝতে পারবেন।