জি বাংলা সারেগামাপা এর গৌরব সরকার এর কথা মনে আছে? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন গৌরব যার মিষ্টি গান আপামর দর্শক শ্রোতাদের মন মাতিয়ে দিয়েছিল এবং যার স্নিগ্ধ হাসি সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছিল আমরা তার কথা বলছি।
ছোটবেলা থেকে গৌরব সঙ্গীতময় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তার ঠাকুমা শ্রীমতি রত্না সরকার একজন কণ্ঠশিল্পী ছিলেন যিনি স্বনামধন্য সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই গৌরব বিভিন্ন ধারার গান শুনে বড়ো হয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের গানের পরিমণ্ডল ছিল তার বাড়িতে। শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকগীতি, নজরুল গীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, সমকালীন আধুনিক তার বাড়িতে সব ধরনের গানের চর্চা হতো। আর দাদুও গান গাইতেন। তার মেজো কাকাও শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী ছিলেন। তার বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং তার ছোট কাকাও গান। গাইতেন। তার পরিবারে তার ঠাকুরমা এবং তার মেজো কাকা ছাড়া কেউই সংগীতকে প্রফেশন করেননি। বাকিরা সকলেই সংগীতকে নিজেদের বেঁচে থাকার রসদ বা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে মনে করতেন।

গৌরবের গানের হাতেখড়ি হয় তার ঠাকুমার কোলে বসে গান শুনে, গান শিখে। অত্যন্ত ছোট বয়স থেকেই ঠাকুরমার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের গান শিখতেন এবং শুনতেন। প্রত্যেক বছর তার দাদুর উদ্যোগে তার পাড়ায় অর্থাৎ পার্কসার্কাস সিআইটি রোডে একটি গানের অনুষ্ঠান হতো পয়লা বৈশাখের দিন। ঐদিন তার পরিবারের সমস্ত সদস্য সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই সেই অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। গৌরব খুব ছোট বয়স থেকেই ওই অনুষ্ঠানে গান গাইতেন।
তিনি বলেন সঙ্গীত শিখতে কখনোই তাকে বেগ পেতে হয়নি। তার পরিবার-পরিজনের থেকে কখনো এটা শুনতে হয়নি পরীক্ষার সময় শুধু পড়ো গান গেয়োনা।
তিনি বলেন এমন আমার সঙ্গে বহুবার হয়েছে যখন পরীক্ষার আগের দিনও আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে গেছি আমাকে বাড়ি থেকে কখনো গান গাওয়া নিয়ে কোনো রকম বাধা দেয়া হয়নি। ছোটবেলা হোক বা বড়ো হওয়ার পর হোক গানটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়েছে সে ক্ষেত্রে কোনো রকম বাধা বা প্রতিবন্ধকতা পরিবারের তরফ থেকে কখনও আসেওনি আর আমি কখনো অনুভবও করিনি। লেখাপড়া, সংগীত দুটোই সমান্তরালভাবে এগিয়েছে।আমায় কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি।

গৌরব হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল মিউজিক ক্লাস ওয়ান থেকে শেখা শুরু করেন পন্ডিত আনন্দ গুপ্তার কাছে। ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন অডিশন দিয়ে সুযোগ পান আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে। সেখানে তিনি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর সঙ্গীতের তালিম নেন। এরপর এক থেকে দেড় বছর তেমনভাবে কোন গুরুর কাছে শিখতে পারেননি। পরবর্তীকালে ২০০৯ সাল থেকে তিনি শ্রী গৌতম ঘোষাল এর কাছে গানের তালিম নেওয়া শুরু করেন এবং প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি তাঁর কাছেই সঙ্গীতের তালিম নিচ্ছেন।
শাস্ত্রীয় সংগীত সম্পর্কে তিনি বলেন “ভাষা শিখতে হলে যেমন তার বর্ণমালা শিখতে হয়, সংগীতও হলো সাতটা নোটের কম্বিনেশন। প্রত্যেকের গানের ক্ষেত্র পৃথক হতে পারে কিন্তু এই সাতটা নোটের জ্ঞান সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং লোকসংগীত আমাদের শিকড়, এগুলি আমাদের সংগীতের শাখা-প্রশাখা বিস্তারে অনেক সাহায্য করে। আমাদের এই শিকড় কে কখনো ভুললে চলবেনা। শাস্ত্রীয় সংগীতকে সবসময় আঁকড়ে বাঁচতে হবে।
রেওয়াজ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমাদের সংগীতচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল রেওয়াজ। ঘরে বসে রেওয়াজ করলেই যে শুধুমাত্র রেওয়াজ করা হয় তা একেবারেই ভুল কথা। অনেক বেশি করে শুনতেও হবে। আমাদের গলার বিশ্রামেরও প্রয়োজন আছে। গলায় অত্যাধিক জোর দিলে গলাও টায়ার্ড হয়ে যায় যা একজন গায়ক বা কণ্ঠশিল্পীর জন্য খুবই খারাপ”।

সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল মিউজিক রেভলিউশন এর সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,”আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবকিছু জানতে পারছি সবক্ষেত্রেই সবকিছু। সংগীতের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখন আমাদের কাছে সময় খুবই কম। আমাদের মধ্যে ধৈর্য্য নেই ভালো কাজ শোনার, ভালো গান শোনার। আমরা বাইরের চটকদারিতেই বেশি আকর্ষিত হয়ে পড়ি। ভালো গানের গুণগত উৎকর্ষতা শোনবার মতো সময় আর ইচ্ছা কোনটাই আমাদের মধ্যে নেই”।
গৌরব বলেন আগে বিভিন্ন এফএম চ্যানেলে আধুনিক বাংলা গান তা সে ছবির হোক বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্টিস্টদের হোক না কেন সময় ধরে বাজানো হতো কিন্তু এখন হিন্দি ছবির গানের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেছে। বেশিরভাগ এফ এম রেডিও চ্যানেলে বেশিরভাগ সময়ই হিন্দি গান বাজানো হয়। বাংলা ছবির গান বাজলেও ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্টিস্টদের গান এখন আর এই প্রাইভেট রেডিও চ্যানেলগুলিতে শুনতে পাওয়া যায় না।
তার আগামী প্রজেক্ট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান “খুব শীঘ্রই আমার গাওয়া ‘সে যে বোঝেনা’ গানটি বিভিন্ন অডিও স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে আগে মুক্তি পাবে। তার কিছুদিন পর এই গানটির মিউজিক ভিডিও মুক্তি পাবে কারণ আমি গতানুগতিকতায় বিশ্বাস করিনা। আমি চাই মানুষ আগে গানটা ভালোভাবে শুনুক। গানটির অডিও মুক্তির কিছুদিন পরেই গানটির মিউজিক ভিডিও মুক্তি পাবে”।

তাছাড়া তার কন্ঠে গাওয়া একটি নজরুলগীতিও আসতে চলেছে । এছাড়াও সারেগামাপা এর বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গেও তিনি যৌথভাবে কাজ নিয়ে উপস্থিত হবেন আমাদের সামনে। স্বাধীনতা দিবসের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট তার আরেকটি গান আসছে। আগামী বছর তাঁর গাওয়া একটা নতুন বাংলা গানের অ্যালবাম আসতে চলেছে। এই বাংলা গানের অ্যালবামটিতে মোট আটটি মৌলিক বাংলা গান থাকবে। এই গানগুলির মধ্যে অনেকগুলোই সুর করেছেন জনপ্রিয় সুরকার শ্রী জয় সরকার, শ্রী গৌতম ঘোষাল এবং নতুনদের মধ্যে রনজয় ভট্টাচার্য, সৌপ্তিক, শোভন, অনন্যা। এই গানগুলির মধ্যে দুটো গান কবি শ্রীজাতর লেখা। এই অ্যালবামটির সঙ্গে মহুল-দীপরাজ, অর্ঘ্য ব্যানার্জীও যুক্ত রয়েছেন।
সবশেষে তিনি এটাও জানান নতুন বাংলা গানের কাজ তিনি অবশ্যই চালিয়ে যাবেন।